Site icon জনতার বার্তা | জনগনের পক্ষে, জনতার কথা বলে

৫৪ কেজিতে আমের মণ, জিম্মি চাঁপাইনবাবগঞ্জের চাষিরা

৫৪ কেজিতে আমের মণ, জিম্মি চাঁপাইনবাবগঞ্জের চাষিরা

ছবি: জনতার বার্তা

চাঁপাইনবাবগঞ্জ প্রতিনিধি: বিরূপ আবহাওয়া ও অফ ইয়ারের প্রভাবে এবার আমের রাজধানীখ্যাত জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জে এবছর আমের ফলন কম। যে পরিমাণ আম উৎপাদন হয়েছে, তাতে খরচ উঠানো নিয়েই শঙ্কায় আমচাষীরা। এরপর মরার উপরে খাড়ার ঘা আমচাষীরা জিম্মি হয়ে পড়েছেন আড়তদারদের কাছে। দেশের সবচেয়ে বড় আমবাজার কানসাট, রহনপুর, ভোলাহাট আম বাজার ঘুরে দেখা গেছে, আমচাষীদের অনেকটা জিম্মি করেই ৫২-৫৪ কেজিতে এক মণ ধরে আম কিনছেন আড়তদাররা।

বাড়তি কেজিতে আম বিক্রিতে অপারগতা প্রকাশ করলেই চাষীদের সাথে অসদাচরণ ও আম কেনা বন্ধের হুমকি দেয়ার অভিযোগ উঠেছে। এক মণ আমে ১২-১৪ কেজি বেশি নেয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত জেলার আমচাষীরা। আমচাষীদের দাবি, সকল বাজারে একই পরিমাণে ও সহনীয় ওজনে আম কেনাবেচার। এনিয়ে চাষীরা গতবছর কৃষিমন্ত্রীর কাছেও অভিযোগ দিয়েছেন। কিন্তু নেয়া হয়নি কোন ব্যবস্থা।

আড়তদারদের কাছে জিম্মি হয়ে বাধ্য হয়েই অতিরিক্ত ১২-১৪ কেজি বেশি দিয়ে আম বিক্রি করতে হচ্ছে আমচাষীদের। গত কয়েক বছর ধরে চলা এই অনিয়ম যেন দেখার কেউ নেই। প্রশাসন ও কৃষি মন্ত্রণালয়ে বারবার অভিযোগ দিলেও সুরাহা পাচ্ছেন না হাজার হাজার আমচাষী। বাধ্য হয়েই অন্তত ৫০০ কোটি টাকার আম অতিরিক্ত দিতে হচ্ছে আড়তদারদের কাছে।

আমচাষী ইয়াসিন আলী সম্রাট বলেন, গত কয়েক বছর ধরে জ্যামিতিক হারে আমের ওজনের পরিমাণ বাড়ছে। ৪৪ কেজি থেকে শুরু হয়ে এখন ৫৪ কেজিতে গিয়ে ঠেকেছে। একপ্রকার জোর করেই ৫৪ কেজিতে মন হিসেবে আম কিনছে আড়তদাররা। দিতে না চাইলে পুরো সিন্ডিকেট মিলে আম কেনা বন্ধ করার হুমকি দেয়। আম যেহেতু কাঁচামাল, তাই পঁচে নষ্ট হওয়ার ভয়ে বাধ্য হয়েই অতিরিক্ত ১২-১৪ কেজি আম দিতে হয়।

উদ্যোক্তা সাহিন আলী জানান, গত কয়েক বছরে আমরা এবিষয়ে প্রশাসনকে বারবার বলেও কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। শুধু আশ্বাসেই আটঁকে আছে বিষয়টি। এর সুরাহা হওয়া প্রয়োজন। কারন এই বিষয়টি এখনই সমাধান না হলে দিনদিন বাড়তে থাকবে। অতিরিক্ত আম নেয়াটা কৃষকদের উপর একটা ঝুলুম। যা সহ্য করেই বছরের পর বছর আমাদেরকে আম দিতে হচ্ছে।

কৃষক শফিকুল ইসলাম বলেন, এবছর আবহাওয়া ও অফ ইয়ারের কারনে গাছে ফলন প্রায় ৪০ শতাংশে নেমেছে। উৎপাদন খরচ উঠানো নিয়েই শঙ্কা দেখা দিয়েছে আমচাষীদের মাঝে। কম ফলনের বছর হওয়ার পরেও যদি এভাবে মণে অতিরিক্ত ১২-১৪ কেজি আম দিতে হয়, তাহলে আরও বিপদগ্রস্ত হয়ে পড়বে আমচাষীরা। আমাদের দাবি, বিষয়টির দ্রুত সমাধান করা হোক।

কানসাট বাজারে ল্যাংড়া ও আম্রপালি আম বিক্রি করতে এসেছিলেন আব্বাস বাজার এলাকার বাসিন্দা তরিকুল আলম। তিনি বলেন, গত চার বছর আগে আমরা ৪২-৪৩ কেজিতে মণ ধরে আম বিক্রি করেছি। কিন্তু ২০২২ সালে ৪৮ কেজিতে মণ ধরে আম ক্রয় করেন আড়তদাররা। সেই থেকে বছর বছর বাড়ছে ওজনের পরিধি। চলতি বছর ৫২ থেকে ৫৪ কেজিতে মণ ধরে আম ক্রয় করছেন তারা। আমরা এখন বিপাকে। কোথায় যাবো, কার কাছে বলবো এ অনিয়মের কথা?

মুসলিমপুর গ্রামের বাসিন্দা আজিজুল ইসলাম বলেন, এ বছর অন্য বছরের থেকে গাছে আম অনেক কম এসেছে। এদিকে আম বিক্রি করতে এসে শুনছি ৫২ কেজিতে এক মণ ধরা হবে। এতে আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছে। গত বছরও আমাদের জিম্মি করে ৫০ কেজিতে মণ নিয়েছেন আড়তদাররা। এবার ফের ৫২ কেজিতে মণ নিচ্ছেন। অনেক সময় টালবাহানা করে অন্তত ৫৪ কেজিতে আমের মণ নিচ্ছেন আড়তদাররা।

এবিষয়ে কানসাট আম আড়তদার ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক ওমর ফারুক টিপু বলেন, শুধু কানসাট নয়, রাজশাহী, নওগাঁ, গোমস্তাপুর, ভোলাহাট সব স্থানেই বিষয়টি নিয়ে ঝামেলা হচ্ছে। আমরা চাই রাজশাহী বিভাগের সব আম বাজারে এক ধরনের ওজন নির্ধারণ করা হোক। এটি নিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথাবার্তা চলছে। আমারা বিষয়টি নিয়ে কয়েকদিন আগেও বৈঠকে বসেছিলাম। কিন্তু সমাধানে পৌঁছাতে পারিনি।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ ম্যাংগো ফাউন্ডেশনের সদস্য সচিব আহসান হাবিব বলেন, আমরা কষ্ট করে আম উৎপাদন করি। কিন্তু আড়তদাররা মণে ১২-১৫ টা আম বেশি নিচ্ছে। ৫০-৫৫ কেজিতে মণ ধরে আম কিনছেন তারা। এ অনিয়ম কয়েক বছর আগে থেকেই হয়ে আসছে। আমরা এই সিন্ডিকেটের হাত থেকে মুক্তি চাই।

তিনি আরও বলেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ ও রাজশাহীতেও আমের ওজন নিয়ে ঝামেলা হয়। আমরা চাই সব আম বাজারে ওজনের মাপ যেন একই হয়। আমরা কৃষিমন্ত্রীর কাছেও অভিযোগ দিয়েছি কিন্তু কোনো ব্যবস্থা হয়নি। মণপ্রতি ১২-১৪ কেজি করে যে অতিরিক্ত আম নেয়া হয়, তার বাজারমূল্য অন্তত ৫০০ কোটি টাকা বলেও জানান তিনি।

শিবগঞ্জ ম্যাংগো প্রডিউসার কো-অপারেটিভ সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক ইসমাইল খান শামীম বলেন, জেলায় মোট তিনটি আম বাজার, একেক বাজারে একেক ওজন চলে। তাই আমরা তিনটি আম বাজার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বসেছিলাম কিন্তু সমাধান করতে পারিনি। এখন কানসাটে ৫২ কেজিতে মণ ধরে আম ক্রয় করছেন আড়তদাররা।

শিবগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মো. উজ্জল হোসেন বলেন, কানসাট আম বাজারে ওজন নিয়ে ঝামেলার বিষয়টি শুনেছি। তবে এখন পর্যন্ত কোন আমচাষী আমাদের কাছে লিখিত অভিযোগ করেননি। তারপরও আমি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে বিষয়টি সমাধানের চেষ্টা করবো। এছাড়াও একটি সুষ্ঠ সমাধানের লক্ষ্যে এবিষয়ে কৃষি মন্ত্রনালয়ে লিখিত পত্র দেয়া হয়েছে।

কৃষি বিভাগের তথ্য মতে, চলতি মৌসুমে চাঁপাইনবাবগঞ্জে ৩৭ হাজার ৬০৪ হেক্টর জমিতে আম বাগান রয়েছে। উৎপাদেরন লক্ষমাত্রা নির্ধারন করা হয়েছে প্রায় সাড়ে ৪ লাখ মেট্রিক টন আম।

হানিফ মেহমুদ/এস আই আর

Exit mobile version