Site icon জনতার বার্তা | জনগনের পক্ষে, জনতার কথা বলে

অপকর্মের মাফিয়া ‘ব্যাডবয়’ তৌহিদ আফ্রিদি

অপকর্মের মাফিয়া ‘ব্যাডবয়’ তৌহিদ আফ্রিদি

ছবি: তৌহিদ আফ্রিদি।

বিতর্কিত ও সমালোচিত কনটেন্ট ক্রিয়েটর তৌহিদ আফ্রিদি। ফর্সা চেহারার আড়ালে তাঁর প্রতারণা ও নোংরা কর্মকাণ্ডের কালো মুখোশ এখন সবার সামনে উন্মোচিত হচ্ছে। চটকদার কনটেন্টে সাধারণ দর্শক-শ্রোতাদের বুঁদ করে রাখলেও   তিনি আসলে অপরাধ জগতের মাফিয়া। বাবা নাসির উদ্দিন সাথীর অপকর্মের পার্টনার আফ্রিদি নারী কেলেঙ্কারির হোতা, উঠতি তরুণীদের ‘ব্যাডবয়’ আর নতুন কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের কাছে ‘ভয়ংকর’ নির্যাতনকারী হিসেবে পরিচিত।

এখন আবার আলোচিত মুনিয়া হত্যায়ও তাঁর জড়িত থাকার কথা উঠেছে। আর এত সব অপরাধের ‘মাস্টারমাইন্ড’ হওয়ার পরও বাপের দখল করা মাই টিভির ‘ব্যাকআপে’ আর হাসিনা সরকারের আইনমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রশ্রয়ে তিনি ছিলেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। অবশেষে বাপ-ছেলের গ্রেপ্তারের পর তাঁদের অন্তহীন অপকর্ম ও অন্ধকার জগতের অজানা সব তথ্য ভুক্তভোগীদের মাধ্যমে সবার সামনে আসছে। আফ্রিদি ও তাঁর বাবা সাথী দুজনই এখন কারাগারে। তাঁদের সব অপকর্মের তদন্ত চলছে।

তথ্য-উপাত্ত ও ভুক্তভোগীদের দেওয়া বক্তব্যে আরো জানা যায়, আফ্রিদির বাবা নাসির উদ্দিন সাথী একজন দখলবাজ। একদা চালচুলোহীন এই অর্থলোভী আরেকজনের মালিকানাধীন মাই টিভি দখলের পর নিজের পাশাপাশি ছেলে তৌহিদ আফ্রিদিকেও অন্ধকার জগতের ‘নায়ক’ হিসেবে গড়ে তোলেন। নিজে টিভির আড়ালে সব অপকর্ম করেন প্রভাব খাটিয়ে, আর ছেলেকে লেলিয়ে দেন ‘গ্লামার্স গার্লদের’ পেছনে।

বাবার ক্ষমতার ‘পাওয়ারহাউস’ মাই টিভির নাম ভাঙিয়ে আফ্রিদিও হয়ে ওঠেন বেপরোয়া। এই সুযোগে কনটেন্ট ক্রিয়েটর বানিয়ে দেওয়ার প্রলোভনে আফ্রিদি তরুণ কনটেন্ট ক্রিয়েটর থেকে শুরু করে উঠতি সুন্দরী তরুণীদের সঙ্গে হেন কোনো অন্যায়-অন্যায্য কাজ নেই যা করেননি। সম্পত্তি দখল থেকে ব্ল্যাকমেইল—সবই করেছেন আফ্রিদি।

জানা যায়, ঢাকা মহানগর ডিবি প্রধান হারুনের (হারুন অর রশীদ) সরাসরি শেল্টার, আওয়ামী সরকারের সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের ছত্রচ্ছায়ায় চলতেন তৌহিদ আফ্রিদি। ফলে আওয়ামী আমলে কোনো অপরাধেই আফ্রিদিকে আইনের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়নি।

অনেক ভুক্তভোগী প্রাণনাশের ভয়ে মুখও খুলতে সাহস পাননি তখন। অবশেষে গত রবিবার রাতে বরিশাল মহানগরের বাংলাবাজার এলাকায় সিআইডির বিশেষ অভিযানে গ্রেপ্তার হন বিতর্কিত তৌহিদ আফ্রিদি। এরপরই একে একে প্রকাশ্যে আসতে শুরু করেছে তাঁদের অপকর্মের কথা। মুখ খুলতে শুরু করেছেন আফ্রিদির বন্ধুমহল থেকে শুরু করে একাধিক কনটেন্ট ক্রিয়েটর, ঘরবাড়ি হারানো মানুষজন ও ভুক্তভোগী তরুণীরা। আর এতে উঠে আসছে তাঁদের বাপ-বেটার সব অপরাধের ফিরিস্তি।

এদিকে দায়িত্বরত সংশ্লিষ্ট আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বলছেন, যেভাবে গ্রেপ্তারের পর আফ্রিদির বিরুদ্ধে ভুক্তভোগীরা নানা মাধ্যমে অভিযোগ দিচ্ছেন, সেগুলো স্পষ্ট করে লিখিত আকারে তাঁদের কাছে দিলে যাছাই-বাছাই করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

আফ্রিদির গ্রেপ্তারের পর এবং আগের সব অভিযোগ বিশ্লেষণে দেখা গেছে, সাধারণত মানুষ যেভাবে জামা-কাপড় পাল্টায়, সেভাবে গত কয়েক বছরে এই আফ্রিদিও মেয়ে বান্ধবী পাল্টেছেন। কোনো তরুণী তাঁর মতের বিরুদ্ধে চললে গোপনে ধারণকৃত অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ভিডিও দেখিয়ে ব্ল্যাকমেইল করতেন। আফ্রিদির অপরাধ জগতের আরেক আইটেম হলো মাদক ব্যবসা। গুলশান-বনানীর বিভিন্ন ক্লাব ও বিত্তবানদের চাহিদা মোতাবেক সব মাদকের সাপ্লাই দিত আফ্রিদির সিন্ডিকেট। অভিযোগ আছে, শুধু মাদকই না, আফ্রিদি তাঁর স্বার্থসিদ্ধির জন্য আওয়ামী আমলের এমপি-মন্ত্রী কিংবা সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকতাদের সঙ্গ দিতে তরুণীদেরও পাঠাতেন। আর কোনো ভয়ভীতি প্রদর্শনের প্রয়োজন কিংবা সহায়তা লাগলে এতে সরাসরি শেল্টার দিতেন ডিবি হারুন। আর হারুনের সঙ্গে আফ্রিদি পরিবারে ছিল “গিভ অ্যান্ড টেক” সম্পর্ক। সেই সম্পর্কে হারুন মাই টিভির সহযোগিতায় গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জে এসপি থাকাকালে সংবাদ করিয়ে চালাতেন চাঁদাবাজির অভিযান। এমনকি ঢাকায় ডিবিপ্রধান হওয়ার পরও হারুন মাই টিভির সর্বোচ্চ ফেভার নিয়েছেন। সর্বশেষ হারুনের নগ্ন ভিডিও ফাঁসের পর আফ্রিদিকে কাজে লাগিয়ে একাধিক কনটেন্ট ক্রিয়েটরকে দিয়ে সেই ভিডিও সরানোর জন্য নির্যাতন চালিয়েছেন বলে একাধিক অভিযোগ পাওয়া গেছে।

নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক একাধিক তরুণী বলেন, ‘আফ্রিদির খপ্পরে যেসব তরুণী, নারী কিংবা কনটেন্ট ক্রিয়েটর পড়েছেন তাঁদের জীবন নাস্তানাবুদ করে ফেলেছে সে। আফ্রিদি সব সময় ডিবি হারুন থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগ ঘরানার বেশ কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তাকে নানাভাবে ম্যানেজ করে এসব ফায়দা লুটেছে। সে বিয়ে ও মডেল বানানোর প্রলোভন দেখিয়ে অসংখ্য তরুণীর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক করেছে। ওই সময় তার ভয়ে আমরা মুখও খুলতে পারিনি। কারণ, তার হাতে সোস্যাল মিডিয়ার একটা বড় নিয়ন্ত্রণ ছিল।’

অন্যদিকে গুলশান থেকে আলোচিত তরুণী মুনিয়ার লাশ উদ্ধারের পর থেকেই নানা অডিও কল রেকর্ডের সূত্র ধরে এই ঘটনায় আফ্রিদির যোগসাজশ আছে বলে বিভিন্ন অভিযোগ করা হয়। কিন্তু আফ্রিদিকে এই দুর্ঘটনা থেকে বাঁচাতে ডিবি হারুন, আওয়ামী সরকারের সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের কারণে সেটা অন্যদিকে প্রভাবিত করানো হয়। অন্যদিকে শামসুল আরেফিন নামের একজনের গার্লফেন্ডকে (রিসা)  ডিবি হারুনের সহায়তায় ভাগিয়ে নিয়ে ট্র্যাপে ফেলে বিয়ে করেছেন আফ্রিদি। ওই সময় শামসুলকে নানা ধরনের হুমকি ও নির্যাতন করিয়েছেন তিনি।

এ ছাড়া সম্প্রতি ‘ক্রাইম এডিশন’ প্রকাশিত একটি ভিডিও প্রতিবেদনে উঠে এসেছে ইউটিউবার ও ব্লগারদের আওয়ামী লীগের পক্ষে জোরপূর্বক কাজ করানো থেকে শুরু করে আফ্রিদির নানা কুকীর্তি। তবে এসবের ভিড়ে আলোচিত হয়েছে মুনিয়ার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক। ফাঁস হওয়া একাধিক ফোনালাপ ও ভুক্তভোগীদের সাক্ষ্য প্রমাণ করে, মুনিয়ার সঙ্গে আফ্রিদির ঘনিষ্ঠতা শুধু ব্যক্তিগত সম্পর্কেই সীমাবদ্ধ ছিল না, এটি মুনিয়ার মৃত্যু রহস্যেও নতুন মাত্রা যোগ করছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, জুলাই আন্দোলন চলাকালে তৌহিদ আফ্রিদি দেশের জনপ্রিয় কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের হুমকি দিয়ে সরকারের পক্ষে কাজে লাগানোর চেষ্টা চালিয়েছেন। তা ছাড়া আফ্রিদির বিরুদ্ধে বেশ কয়েকজন নারীকে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে শারীরিক সম্পর্ক করার অভিযোগও উঠে এসেছে প্রতিবেদনে।

সূত্র: কালের কন্ঠ

Exit mobile version