সোমবার, আগস্ট ৪, ২০২৫
spot_img

ধামইরহাট সফিয়া উচ্চ বিদ্যালয়: ফুলের সৌরভ আর আলোকমালায় ঘেরা শিক্ষাঙ্গনের রূপকথা

নওগাঁ প্রতিনিধি: নওগাঁ জেলার ধামইরহাট উপজেলার প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত সফিয়া পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় আজ আর শুধু একটি সাধারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয়; এটি হয়ে উঠেছে এক নান্দনিক পরিবেশের দৃষ্টান্ত। দিনের বেলা বাহারি ফুলের সৌরভে ভরা বাগান, সবুজের সমারোহ এবং রাতের আলোকসজ্জায় ঝলমলে প্রাঙ্গণ এ বিদ্যালয়কে ঘিরে তৈরি করেছে এক স্বপ্নময় পরিবেশ। শিক্ষা গ্রহণের পাশাপাশি এটি এখন ভ্রমণপিপাসুদের জন্যও একটি বিশেষ আকর্ষণের কেন্দ্র হয়ে দাঁড়িয়েছে।

প্রতিদিন এখানে স্কুলের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে স্থানীয় বাসিন্দা এবং দূর-দূরান্ত থেকে আসা দর্শনার্থীদের ভিড় জমে। বাগানে বসে আড্ডা, ছবি তোলা কিংবা আলোকিত প্রাঙ্গণে সন্ধ্যার শোভা উপভোগ—সব মিলিয়ে বিদ্যালয়টি আজ একটি বিনোদনের কেন্দ্র হিসেবেও খ্যাতি অর্জন করেছে। একসময় এটি ছিল কেবলই একটি সাধারণ স্কুল, কিন্তু বর্তমান চেহারা এর প্রাচীন ঐতিহ্যের সঙ্গে যোগ করেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। শিক্ষার্থীরা তাদের আনন্দঘন অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে গিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছে।

সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী রিফা সানজিদা বলেন, “স্কুলে ঢুকতেই ফুলের বাগান আমাদের মন ভালো করে দেয়। ক্লাসের ফাঁকে আমরা এখানে বসি, আড্ডা দিই আর ছবি তুলি। এমন পরিবেশে পড়তে আসাটাই এখন আনন্দের বিষয়।”

দশম শ্রেণির বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী আব্দুর রাফি বলেন, “আগে স্কুলে আসতে ইচ্ছে করত না, কিন্তু এখন প্রতিদিন আসার জন্য মুখিয়ে থাকি। এমন সুন্দর পরিবেশে পড়াশোনা করাটা সহজ আর উপভোগ্য হয়ে গেছে।”

অষ্টম শ্রেণির আরেক শিক্ষার্থী লিমা আক্তার বলেন, “আমাদের স্কুল শুধু পড়াশোনার জায়গা নয়, এটা আমাদের অবসর কাটানোর প্রিয় স্থানও। ক্লাসের পর বন্ধুদের সঙ্গে বাগানে বসে আড্ডা দেওয়া, বিশেষ দিনগুলোতে ক্যাম্পাসে স্মৃতি তৈরি করা—এসব মুহূর্ত আমাদের জীবনের অংশ হয়ে উঠেছে।”

শিক্ষার্থীদের মতে, এই মনোরম পরিবেশ শুধু মন ভালো রাখে না, বরং পড়াশোনায় মনোযোগ বাড়াতেও সহায়তা করে। শুধু শিক্ষার্থীরাই নয়, আশপাশের এলাকাবাসীর কাছেও বিদ্যালয়টি এক আকর্ষণীয় স্থানে পরিণত হয়েছে।

ধামইরহাট সফিয়া উচ্চ বিদ্যালয়। ছবি: জন অতার বার্তা

স্থানীয় বাসিন্দা মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, “আমরা সন্তানদের পড়াশোনার জন্য এখানে নিয়ে আসি ঠিকই, কিন্তু নিজেরাও মাঝে মাঝে এসে কিছু সময় কাটাই। সন্ধ্যার পর যখন আলোগুলো জ্বলে ওঠে, তখন মনে হয় এটি আর একটি স্কুল নয়, যেন কোনো পার্ক বা রিসোর্ট।”

বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. আব্দুর রহমান বলেন, “আমাদের এই সাফল্য শিক্ষার্থী, শিক্ষক এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফল। শিক্ষার্থীরাই নিয়মিত বাগানের পরিচর্যা করে এবং আমরা শিক্ষকরা আলোকসজ্জার বিষয়ে যত্নশীল থাকি। এর ফলে পড়াশোনায় শিক্ষার্থীদের আগ্রহও অনেক বেড়েছে।”

তিনি আরও বলেন, “আমরা প্রতি মাসে বাগানের পরিচর্যা এবং নতুন গাছ লাগানোর উদ্যোগ নিই, যাতে এই নান্দনিক পরিবেশ ধরে রাখা যায়। এমন পরিবেশে শিক্ষার্থীরা মনোযোগী হয়ে উঠছে এবং তাদের মানসিক বিকাশও হচ্ছে।”

ধামইরহাট সফিয়া পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় শুধুমাত্র নান্দনিকতার কারণে নয়, এর ঐতিহ্যবাহী ইতিহাসের জন্যও সুপরিচিত। ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দের একটি সভার কার্যবিবরণী থেকে এ বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার তথ্য জানা যায়, যা আজও সংরক্ষিত আছে। সে সময়ে এটি ‘মিডিল ইংলিশ স্কুল’ নামে পরিচিত ছিল।

১৯২৮ সালে এই প্রতিষ্ঠানটি ফার্শিপাড়া হাই মাদ্রাসা হিসেবে উন্নীত হয়। পরে ১৯৫০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে এটি ‘ফার্শিপাড়া সফিয়া উচ্চ বিদ্যালয়’ নামে পরিচিতি পায়। পরবর্তীতে, ১৯৬৫ সালে ফার্শিপাড়া থেকে বর্তমান জায়গায় স্কুলটি স্থানান্তর করা হয়। আশির দশকে বিদ্যালয়টি পাইলট প্রকল্পের আওতায় আসে এবং সেই থেকে এর নাম হয় ধামইরহাট সফিয়া পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়।

এই বিদ্যালয়টি ধামইরহাট পৌরসভার প্রাণকেন্দ্রে আমাইতারা মৌজায় অবস্থিত। প্রায় দুই একর একুশ শতক জমির উপর গড়ে ওঠা এ বিদ্যালয়টি জয়পুরহাট-ধামইরহাট-নওগাঁ হাইওয়ের পাশে হওয়ায় ভৌগোলিক দিক থেকেও বিশেষ আকর্ষণীয়। বিদ্যালয়ের নামকরণ করা হয় প্রখ্যাত ব্যক্তিত্ব মুজাফফর রহমান চৌধুরীর দাদা সফিউদ্দিন চৌধুরীর স্মৃতিতে, যা আজও তার ঐতিহ্য বহন করে।

বিদ্যালয়টি শুধু শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার ক্ষেত্রেই উন্নত নয়, এর সৌন্দর্য এবং পরিচ্ছন্নতা রক্ষা করতে নিয়মিত কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। বাগানের পরিচর্যা, গাছপালা রোপণ এবং আলোকসজ্জা রক্ষণাবেক্ষণই এর মূল অংশ।

বিদ্যালয়ের এই উদ্যোগ শুধু শিক্ষার্থীদের মানসিক বিকাশেই নয়, বরং পুরো এলাকাজুড়ে শিক্ষার পরিবেশ উন্নয়নে ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে। শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবক এবং স্থানীয়দের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এই বিদ্যালয়টি আজ এলাকাবাসীর গর্বের প্রতীক হয়ে উঠেছে।

ফুলের সৌরভ, সবুজের সমারোহ এবং ঝলমলে আলোর ছটায় ঘেরা এই প্রতিষ্ঠান শুধু শিক্ষার্থীদের মনের প্রশান্তিই দিচ্ছে না, বরং তাদের মধ্যে সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটাচ্ছে। ধামইরহাট সফিয়া পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় আজ অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্যও একটি অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে বলে আশা করা যায়।

মো: এ কে নোমান/এমএ

- Advertisement -spot_img

রাজনীতি

আবেদন করতে ব্যানারে ক্লিক করুন...spot_img

সর্বশেষ সব খবর