জুয়েল আজ্জম: সময়ের চেয়ে জীবনের মূল্য অপরিসীম। তবে সেই মূল্যবান জীবন যদি শেষ হয়ে যায় অকালে সেখানে সময়ও যেন হয়ে পড়ে মূল্যহীন। সড়ক দুর্ঘটনায় শুধু সময় নয়, অসাবধানতা, বেপরোয়া গাড়ি চালানো কিংবা নিয়তির পরিহাসে ঝরে যায় মূল্যবান জীবন৷ তবে সে মূল্যবান জীবন যদি হয় জাতির মেধাবী, সৃজনশীল ও শ্রেষ্ঠত্ব কেউ তবে সে ক্ষতি অপূরণীয়। সড়ক দুর্ঘটনায় যে সকল পরিবার প্রিয়জনদের হারান, তারা হারানোর সে বেদনা পুরো জীবন বয়ে নিয়ে চলেন।
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী দেখা যায় যে বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনার হার দক্ষিণ এশিয়ায় অনেকটা সর্বোচ্চ অবস্থানে। এছাড়া ২০২৪ সালের এক প্রতিবেদনে দেখা যায় যে বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন প্রায় আট হাজার মানুষ।

সড়ক দুর্ঘটনার তালিকায় রয়েছেন জাতির মেধাবী সন্তানেরাও। বলছি পরিচালক তারেক মাসুদের কথা।
২০১১ সালে ঢাকার অদূরে মানিকগঞ্জে এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনা প্রাণ হারান চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদ ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব মিশুক মুনীর।
তিনি তার ‘কাগজের ফুল’ নামক চলচ্চিত্রের শ্যুটিং লোকেশন দেখার জন্য সহকর্মী দের নিয়ে মানিকগঞ্জে যান। ফেরার পথে ঢাকা-আরিচা মহা সড়কে বিপরীত দিক থেকে আসা বাসের সঙ্গে তার মাইক্রোবাসের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। ঘটনাস্থলেই মারা যান তারেক মাসুদ, মিশুক মুনীর, ওয়াসিম, সেট ডিজাইনার জামাল হোসেন ও চালক মোস্তাফিজ। আহত হন ক্যাথরিন মাসুদ, চিত্রশিল্পী ঢালী আল মামুন, ও তার স্ত্রী চিত্রশিল্পী দিলারা বেগম জলি।
পরবর্তীতে ঢালী আল মামুন সেই বিধ্বস্ত মাইক্রোবাসটি ব্যবহার করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুন্নাহার হলের পাশে তৈরি করেন সড়ক দুর্ঘটনার স্মৃতিস্থাপনা। সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে জনসচেতনতা বাড়াতেই তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরকে নিবেদিত করে তৈরি করা হয়েছে এই ভাস্কর্যটি।
শিল্পী ঢালী আল মামুনের পরিকল্পনায় এই স্থাপত্যের নকশা প্রণয়ন করেন শিল্পী সালাউদ্দিন আহমেদ। সার্বিক ব্যবস্থাপনায় ছিল তারেক মাসুদ ম্যামোরিয়াল ট্রাস্ট। এই স্থাপনা নির্মানে আর্থিক সহায়তা প্রদান করে ব্র্যাংক ব্যাংক।
২০১৪ সালের ১ সেপ্টেম্বর স্থাপত্যটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকী।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুন্নাহার হলের পাশ দিয়ে কোন পথচারী হেঁটে যাবার সময় দেখবেন উন্মুক্ত এই ভাস্কর্যটি। মনে হবে কিছুক্ষণ আগেই হয়তো ঘটেছে দূর্ঘটনা। গাড়ির পাশে ঝুলিয়ে রয়েছে পাঁচটি হাত, যা দ্বারা দূর্ঘটনায় নিহত পাঁচজনকে স্নরণ করিয়ে দেয়। এই ছাড়া গাড়ির ভেতরেও রয়েছে পাঁচটি হাতের ফর্ম। যা গাড়ির ভেতরে তাকালে দৃষ্টি গোচর হয়।

এইছাড়া গাড়ির চাকাগুলো আলগা হয়ে আছে। পড়ে দুমড়ে-মুচড়ে যাওয়া ইন্জিন, তেলের ট্যাংক। এলোপাতাড়ি পড়ে আছে গাড়ির বিধ্বস্ত সিট। যেন সিটগুলো একেকটা ভাষ্কর্য।
ভাস্কর্যটির ভায়োলেন্স কমানোর জন্য ব্যবহার করা হয়েছে সাদা রঙ। তবুও যেন বিধ্বস্ত গাড়ির দূর্ঘটনার চাক্ষুষ ভয়াবহতা দৃশ্যমান হয়ে আছে।
সড়ক দুর্ঘটনার ভয়াবহতার দৃশ্য যেন স্নারক দূর্ঘটনার এই ভাস্কর্যটি। মানুষের মাঝে তৈরি হোক সচেতনা,বন্ধ হোক বেপরোয়া গাড়ি চালানো, নিয়ম মেনে পারাপার হোক রাস্তা।
সড়ক দুর্ঘটনায় অকালে না ঝড়ুক কোন প্রাণ। ঘর থেকে যে প্রাণ বের হবে সে প্রাণ যেন নিরাপদে ফিরে যায় প্রিয়জনের কাছে, নিজের ঘরে।
জুয়েল আজ্জম, সোহরাওয়ার্দী কলেজ প্রতিনিধি