প্রচলিত যানবাহন হতে ব্যতিক্রম ধারার ভ্রমণ মাধ্যম হচ্ছে লঞ্চ ভ্রমণ। কেননা লঞ্চ ভ্রমণ করার প্রারম্ভে আপনাকে কিছু কাজ করতেই হবে, যা সাধারণত গাড়ী বা অন্য ক্ষেত্রে প্রয়োজন হয় না। নদীমাতৃক বাংলাদেশে এক সময় লঞ্চ যাত্রা ছিল মানুষের অন্যতম যাতায়াত বাহন। কালের পরিক্রমায় লঞ্চ যাত্রা মিয়্রমাণ রুপ লাভ করেছে। যদিও আমার লঞ্চ ভ্রমণ নতুন নয়, তবুও এবারের লঞ্চ যাত্রায় আমার ব্যতিক্রমী কিছু অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়েছে। যা লেখবার অভিপ্রায় সংবরণ করা আমার পক্ষে খুবই কষ্টকর।লঞ্চ ভ্রমণের নিমিত্তে ১২ই জুলাই ২০২৩ প্রত্যুষে ঘুম হতে উঠে ফজরের সালাত আদায় করে প্রস্তুতি গ্রহণ শুরু করলাম। কেননা লঞ্চ ও অন্যান্য বাহনের ব্যতিক্রমটা এখান থেকেই শুরু। প্রথমে রিক্সাযোগে আনন্দ বাজার থেকে রওয়ানা করলাম চেয়ারম্যান স্টেশন লঞ্চ ঘাট। লঞ্চ ঘাটে আমার ভ্রমণ সঙ্গী হিসাবে যোগ দিল আমার প্রবাসী বন্ধু মাইনুদ্দিন হাসান। আমি ও মাইনুদ্দিন হাসান যথারীতি লঞ্চে উঠে তৃতীয় তলায় কেবিনে বসলাম।
লঞ্চ চেয়ারম্যান স্টেশন ঘাট হতে সকাল ৮:৩০ মিনিটে ঢাকার সদর ঘাটের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলো। আমি ও আমার বন্ধু কিছুক্ষণ কেবিনে অবস্থান করে চলে গেলাম লঞ্চের নিয়ন্ত্রণ কক্ষে, যেটা লঞ্চের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। তখন লঞ্চ চালাচ্ছিল সহকারী মাস্টার আনোয়ার হোসেন। তিনি অত্যন্ত মনোযোগী আবেঁশে দক্ষ হাতে লঞ্চ চালাচ্ছিল এবং সকল মননশীলতা উজাড় করে পুরানো বাংলা গান শুনছিল।আমিও পাশে দাঁড়িয়ে কিছু সময় তার দক্ষ হাতের লঞ্চ চালনা ও গান শুনলাম। লঞ্চ ইতোমধ্যে চিড়ার চর ঘাটে পৌঁছে গেছে।চিড়ার চর ঘাট হতে লঞ্চ ছাড়ার পর প্রধান মাস্টার মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম আসলেন, তিনি লঞ্চের নিয়ন্ত্রণ নিলেন আর অপর চালক বিশ্রামে চলে গেলেন। আমি আমার কৌতূহল কে সংবরণ করতে ব্যর্থ হয়ে মাস্টারের কাছে গিয়ে লঞ্চ সম্পর্কিত কিছু জানবার চেষ্টা করলাম।
প্রথমে তিনি আমাকে লঞ্চ পরিচালনা কক্ষে আমন্ত্রণ জানালেন, বললেন চা পান করবেন?আমি না সূচক জবাব দিলাম, কেননা তার কথা গুলো মনোযোগ সহকারে শুনবার অভিপ্রায় কে চরিতার্থ করবার জন্য। এখানে বলে রাখা ভাল যে, নদী মাতৃক বাংলাদেশের প্রকৃত চিত্র স্বচক্ষে দেখে নিজের চক্ষুকে শীতল করার জন্য লঞ্চ ভ্রমণের বিকল্প কিছু হতে পারে বলে আমার কাছে অনুমেয় নয়। দিনটি সারাবেলা রৌদ্রোজ্জ্বল থাকার কারণে নদীর তীরবর্তী সবুজ মাঠ ও গ্রামগুলোর আমাকে বিমোহিত করেছে।যা আমার ক্ষুদ্র লেখনি শক্তি দ্বারা তুলে ধরা দুরূহ ব্যাপার। তার কক্ষে বসে নদী তীরবর্তী গ্রামগুলোর সৌন্দর্য আর চালকের অভিজ্ঞতার কথা শুনছিলাম। তিনি তার অভিজ্ঞতার আলোকে বললেন, লঞ্চ চালকের পেশাটি খুবই পেশাদারিত্বের সাথে করতে হয়।কেননা যদি সামান্য পরিমাণ ভূল হয়ে যায় তবে যাত্রীদের প্রাণহানির আশঙ্কা থাকে। তিনি তার অভিজ্ঞতার মধ্যে এই শিল্পের বর্তমান দুরাবস্থার কথা বলছিলেন। তখন তার চক্ষু যুগল অশ্রুসিক্ত হবার উপক্রম। তবে তিনি আশাবাদী এই শিল্প সগৌরবে ফিরবে।
আমি ও মাইনুদ্দিন হাসান (আমার বন্ধু) তার কথা এবং নদীর সৌন্দর্য এবং লঞ্চ যাত্রাটি উপভোগ করছিলাম। তার মধ্যে লঞ্চ মুন্সিগন্জ ঘাটে পৌঁছে যায়। এখানে বলে রাখা ভালো মুন্সিগন্জ ঘাট হতে ঢাকা সদর ঘাট পর্যন্ত নানা ধরনের ছোট বড় ফ্যাক্টরি রয়েছে, যার কারণে নদীর অবকাঠামো গত ক্ষতি ও সৌন্দর্য মারাত্মক রকমের ব্যবহৃত হয়েছে। যা পূর্বের ন্যায় ফিরিয়ে আনা জরুরী। লঞ্চ যাত্রাটি ১২:৫০মিনিটে সদরঘাটে শেষ হয়। আমি ও আমার বন্ধু লঞ্চ হতে নেমে আমাদের কাজে চলে যাই। আমাদের কাজ শেষ করে সন্ধ্যাবেলা আবার মেসার্স ফজলুল হক শিপিং লাইন্স এর বাইজিদ জুনায়েদ লঞ্চের আসলাম। আসার সাথে সাথেই মাস্টার আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন। তিনি কেবিনে গিয়ে প্রথমে আমাদের সবকিছু রেখে উপরে তার কক্ষে আমন্ত্রণ জানালেন। মাইনুদ্দিন হাসান ও আমি চালকের কক্ষে গেলাম। যাওয়ার পর নতুন কিছু অভিজ্ঞতা অর্জন করলাম।
১০:৩০ মিনিটে লঞ্চ সদরঘাট হতে গৌরাঙ্গ বাজারের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলো।রাতে লঞ্চের দুপাশে নানা রঙ বেরঙ্গের লাইট জ্বালানো থাকে যা দেখতে খুবই সুন্দর। চালক এক ধ্যানে তার লঞ্চকে গন্তব্যে নেয়ার জন্য লঞ্চ চালিয়ে যাচ্ছে। আমি মাস্টার সাইফুল ইসলাম ভাইকে তার চালক জীবনের স্মরণীয় স্মৃতি বলার অনুরোধ করলাম, প্রত্যুত্তর শিহরণ দেয়ার মত একটি ঘটনার আলোকপাত করলেন। তিনি বলেন, একদিন রাতে হঠাৎ করে ঢাকা হতে ফোন আসলো লঞ্চ খুব দ্রুত তীরে নোঙ্গল করো। আমি লঞ্চ তীরে চাঁপানোর প্রস্তুতি নিবো শুরু হলো প্রচন্ড ঝড়। আমি অনেক চেষ্টা করে আমার অবচেতন মনে এক চরে নোঙ্গর করি। মাঝ নদীতে যেই ঝড়ের তান্ডবলীলা ছিল, যদি আমি হাল ছেড়ে দিতাম সেদিন শতশত লোকের প্রাণহানির সম্ভাবনা ছিল। লঞ্চ যাত্রার ব্যতিক্রমী অভিজ্ঞতার মাঝে লঞ্চ শিল্পের সাথে জড়িত শ্রমিকদের স্মৃতিকাতর গল্পগগুলো বারংবার তাড়িত করছে। কেননা আজকের এই সময়ে তাঁদের জীবনমান পূর্বের ন্যায় সমান নয়। যা তাদের স্বাভাবিক জীবনকে ব্যহত করছে।
লেখক:
নাম: জে এম রফিকুল সরকার
শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়