নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি: সাম্য, বিদ্রোহ, মানবতার কবি, বাংলাদেশের জাতীয় কবির নামে ময়মনসিংহের ত্রিশালে গড়ে উঠেছে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়। কবি নজরুলের কৈশোরের কিছুকাল কেটেছিলো এখানে। এখানেই কবি দরিরামপুর হাই স্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে পড়তেন, আর যে বটের তলে বসে রাখাল কবি বাঁশি বাজাতেন তার পাশেই শুকনি বিলে ২০০৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় দেশের ৮ম সাধারণ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়টি।
কবির স্মৃতিকে স্মরণীয় করে রাখতে বৃহত্তর ময়মনসিংহ সাংস্কৃতিক ফোরাম ১৯৯০-এর দশক থেকে বেসরকারি খাতে ত্রিশালে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের নামে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য একটি কমিটি গঠন করেন। সেই ধারাবাহিকতায় দাতা সদস্য ও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় পরবর্তীতে প্রতিষ্ঠা লাভ করে এই বিদ্যাপিঠ। দেড়যুগ পেরিয়ে ১৯তম বর্ষে পদার্পণ করেছে নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়। শিক্ষা, গবেষণা, উন্নয়ন প্রতিপাদ্য নিয়ে সগৌরবে সংকট ও সাফল্যে এগিয়ে যাচ্ছে ৫৭ একরের প্রতিষ্ঠানটি, যেখানে ২৫ টি বিভাগে অধ্যয়ন করছে প্রায় দশ হাজার শিক্ষার্থী।
জাতীয় কবির স্মৃতিকে ধারণ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন স্থাপনার নামকরণ করা হয়েছে কবি নজরুলের সৃষ্টিকর্মের নামে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রে রয়েছে মধ্যবয়সী কবি নজরুলের দীপ্তিমান ভাস্কর্য। শহীদের স্মৃতিতে নির্মিত সৌধের নামকরণ করা হয়েছে কবির বিদ্রোহী কবিতার পঙ্কতি ‘চির উন্নত মম শির’ থেকে। নজরুলের কাব্যগ্রন্থ ‘অগ্নিবীণা ও দোলনচাঁপা’র নামে রয়েছে দুটি শিক্ষার্থী আবাসন হল। বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ব্যথার দান’ নামের মেডিকেল সেন্টারটির নামও কবির গল্পগ্রন্থের নাম থেকে নেয়া।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী পরিবহণগুলোর নাম রাখা হয়েছে নজরুলের সাহিত্যকর্মের নামে। যেমন: বিদ্রোহী, ধুমকেতু, ঝিঙে ফুল, প্রভাতী, বাঁধনহারা, বিদ্যাপতি, প্রলয় শিখা, দক্ষিণ হাওয়া, সওগাত, সাম্যবাদী প্রভৃতি নামের বাস প্রতিদিন শিক্ষক-শিক্ষার্থী নিয়ে যাতায়াত করে।
বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্যের বাসভবনের নাম ‘দুখু মিয়া’ বাংলো। বাংলোর ফটকে ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের সামনে রয়েছে কবি নজরুলের মুরাল। এছড়াও ‘গাহি সাম্যের গান’, ‘চুরুলিয়া’ ও ‘জয়ধ্বনি’ নামে রয়েছে তিনটি মঞ্চ, যেখানে বছরজুড়ে শিক্ষার্থীরা নানান সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে মেতে ওঠে।
শিক্ষার্থীদের শিক্ষা ও গবেষণার উন্নয়নের জন্য প্রচলিত বৃত্তিগুলোর নামকরণ করা হয়েছে, ‘প্রমিলা বৃত্তি’, ‘বুলবুল বৃত্তি’, ‘কাজী অনিরুদ্ধ বৃত্তি’, যা কবি পরিবারের সদস্যদের নাম থেকে নেয়া। তাছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে রয়েছে নজরুলের সাহিত্য সমৃদ্ধ নজরুল কর্ণার। কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্যকর্মের উপর উচ্চতর গবেষণার জন্য রয়েছে ‘ইনস্টিটিউট অব নজরুল স্টাডিজ’। যেখানে বর্তমানে ১০৩ জন শিক্ষক-শিক্ষার্থী নজরুলের জীবন ও কর্ম বিষয়ে পৃথক গবেষণাকর্মের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন। স্নাতক পর্যায়ের সকল বিভাগের শিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে ‘নজরুল স্টাডিজ’ নামের বাধ্যতামূলক কোর্স। নজরুলের জীবনকর্ম ও সাহিত্যের উপর গবেষণা চলমান রাখার জন্য বিভিন্ন শাখায় চালু আছে পিএইচডি এবং এমফিল প্রোগ্রাম। নজরুল শিল্প, সাহিত্য, সঙ্গীতে গবেষণাকর্মে অবদান রাখার জন্য দেশ-বিদেশের গুণীদের হাতে তুলে দেওয়া হয় ‘নজরুল পদক’।
কবির স্মৃতিকে বুকে উজ্জিবীত করে প্রতিবছর পালিত হয় নজরুল জন্মজয়ন্তী ও নজরুল বইমেলা। নজরুলের প্রয়াণ দিবসকে ঘিরেও থাকে নানান আয়োজন।
ময়মনসিংহ, ত্রিশালের এই নামাপাড়া বটতলায় কবির কৈশোর, প্রাকৃতিক শোভা, উন্মুক্ত প্রান্তর সহপাঠীদের সাথে বাউন্ডলেপনা উজ্জীবিত করেছিল তার কবি প্রতিভাকে। এই প্রতিভা বাঙালীকে দিয়ে গেছে অমুল্য সব সৃষ্টিকর্ম। সেসব মহান কর্ম যাতে বিলীন হয়ে না যায়, তার রক্ষক হিসেবেই যেন কাজ করছে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়।
কবি এই অঞ্চলের স্মৃতি রোমন্থনে ১৯২৬ সালে বলেছিলেন, “এই ময়মনসিংহ জেলার কাছে আমি অনেক ঋণী। আমার বাল্যকালে অনেকগুলি দিন ইহারি বুকে কাটিয়া গিয়াছে। এখানে থাকিয়া আমি কিছুদিন পড়াশুনা করিয়া গিয়াছি। আজও আমার মনে সেই সব প্রিয় স্মৃতি উজ্জ্বল হইয়া জ্বলিতেছে।”
মোঃ সাইফুল ইসলাম/এস আই আর