বৃহস্পতিবার, মে ৯, ২০২৪
spot_img

জাল সনদ তৈরি হতো পল্টনের ছাপাখানায়

কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের সনদ কেলেঙ্কারিতে প্রধান সিস্টেম অ্যানালিস্ট এ টি এম শামসুজ্জামানসহ তার চক্রের কয়েক সদস্যকে গ্রেপ্তারের পর চমকপ্রদ সব তথ্য বেরিয়ে আসছে। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গুরুত্বপূর্ণ এই শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান ও পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক থাকলেও সনদ বিতরণে সমান্তরাল বোর্ড খুলে বসেছিল অসাধু-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সিন্ডিকেট। এ ক্ষেত্রে ঊর্ধ্বতন ও দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের গাফিলতিও সামনে এসেছে।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কর্মকর্তারা বলছেন, সনদ জালিয়াত চক্রের সদস্যরা রাজধানীর পল্টনের একটি বেসরকারি ছাপাখানায় কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের জাল সনদ ছাপার কাজ করে আসছিল। এই সনদের কাগজ কেনা হতো ফকিরাপুল এলাকা থেকে। এরপর তা কম্পিউটারের মাধ্যমে অনেকটা নিখুঁত করে আসল সনদের পেপারের মতো নিরাপত্তা ফিচারগুলো যুক্ত করা হতো। এরপর চাহিদা অনুযায়ী তা বিক্রি করত সিন্ডিকেটের সদস্যরা। পরে শামসুজ্জামান তা বোর্ডের সার্ভারে আপলোড করার ব্যবস্থা করতেন।

সম্প্রতি জাল সনদ তৈরি ও বিক্রির অভিযোগে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা (ডিবি) লালবাগ বিভাগের সদস্যরা কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের প্রধান সিস্টেম অ্যানালিস্ট শামসুজ্জামান ও তার সহযোগী ফয়সাল হোসেনকে গ্রেপ্তার করে। পরে তাদের দেওয়া তথ্যানুযায়ী গ্রেপ্তার হন নড়াইলের সার্ভে ইনস্টিটিউটের পরিচালক সানজিদা আক্তার কলি, হিলফুল ফুজুল কারিগরি প্রতিষ্ঠানের প্রিন্সিপাল সরদার গোলাম মোস্তফা ও যাত্রাবাড়ীর ঢাকা পলিটেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজের পরিচালক মাকসুদুর রহমান। এরপর বেরিয়ে আসে এই চক্রের সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে খোদ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান আলী আকবর খানের স্ত্রী শেহেলা পারভীনের! বিষয়টি সামনে আসার পর তোলপাড় শুরু হয়। ডিবি পুলিশ তাকেও গ্রেপ্তার করে হেফাজতে নেয়। ওই ঘটনায় ওএসডি হন বোর্ডের চেয়ারম্যান। তাকে গোয়েন্দা জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখিও হতে হয়। জিজ্ঞাসাবাদের মুখে পড়েন পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মো. কেপায়েতুল্লাহও।

গোয়েন্দা লালবাগ বিভাগের ডিসি (অতিরিক্ত ডিআইজি পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত) মশিউর রহমান কালবেলাকে বলেন, এখন পর্যন্ত তদন্তে পাওয়া তথ্য, আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদ ও আদালতে দেওয়া জবানবন্দি অনুযায়ী চক্রটি ৫ হাজারের বেশি শিক্ষার্থীর কাছে সনদ বিক্রি করেছে। চক্রটি এই সনদ পেপার কোথায় পেল, সেই তদন্তে নেমে গত বুধবার রাজধানীর খিলগাঁও থেকে কামরুল হাসান আবেদ নামে এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর তাকে জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসে তার মাধ্যমেই কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের জাল সনদ ও নম্বরপত্রের ফাঁকা পেপার তৈরি করা হচ্ছিল।

ডিবির এই কর্মকর্তা বলেন, কামরুল মূলত পল্টনে একটি কম্পিটার কম্পোসের দোকানে ডিজাইনার হিসেবে কর্মরত। চক্রের সদস্যদের সঙ্গে সখ্য গড়ে ওঠার পর সে পল্টনের একটি ছাপাখানায় এই জাল সনদ ও নম্বরপত্রের ফাঁকা পেপার তৈরি করত। এ জন্য কাগজ কিনতো ফকিরাপুল এলাকা থেকে। এর আগে নিজেই বোর্ডের আসল পেপারের মতো হুবহু নিরাপত্তাছাপ ও একই সাইজের পেপার কাটিং করত। যদিও এই সনদ তৈরির কথা বিজি প্রেস বা সিকিউরিটি প্রেসে।

যেভাবে সনদ জালিয়াতি চক্রের সঙ্গে পরিচয় কামরুলের: গ্রেপ্তারের পর কামরুল ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন, তার দোকানে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে কয়েক জন লোক আসেন। তারা জানান যে, তাদের সনদ পেপার শেষ হয়ে গেছে। দ্রুত কিছু পেপার তৈরি করতে হবে। তখন তিনি তা তৈরি করে দিতে বোর্ড চেয়ারম্যান বা পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের অনুমতিপত্র ও কার্যাদেশপত্র চান। চক্রের লোকজন কয়েকদিন পর বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মো. কেপায়েতুল্লাহ স্বাক্ষরিত অনুমতিপত্র ও কার্যাদেশপত্র দেন। তাকে সনদের ৫০০ ফাঁকা পেপার ও ৫০০ নম্বরপত্রের ফাঁকা পেপার তৈরির অনুমতি দেওয়া হয়।

কামরুল জানিয়েছেন, অনেক পরে বুঝতে পারেন, তার কাছে আসা লোকজন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের হলেও তারা তাকে দিয়ে অবৈধ কাজ করাচ্ছেন। এরপর তিনি ধীরে ধীরে ওই চক্রের সঙ্গে মিশে যান।

কামরুলকে গ্রেপ্তার অভিযানে থাকা ডিবি সূত্র জানায়, কামরুলের খিলগাঁওয়ের ভাড়া বাসায় অভিযান চালিয়ে তার খাটের তোশকের নিচ থেকে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের নম্বরপত্র ও সনদের ফাঁকা পেপার জব্দ করা হয়। ওই সময় এই ব্যক্তি চ্যালেঞ্জ করে বলেন, এগুলো তৈরি করতে তার অনুমতিপত্র রয়েছে। বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের স্বাক্ষরিত অনুমতিপত্রও দেখান তিনি। তখন ডিবির অভিযানিক দল পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক কেপায়েতুল্লাহকে ফোন দিলে তিনি বলেন, এ ধরনের কার্যাদেশ বা অনুমতিপত্র তিনি কাউকে দেননি। এরপর নিশ্চিত হয়ে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।

ডিবির লালবাগ বিভাগের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা বলেন, কামরুলের সঙ্গে সম্পৃক্ত কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের বেশ কয়েকজনকে চিহ্নিত করা হয়েছে। তাদের নজরদারিতে রেখে আরও তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করা হচ্ছে। সব প্রমাণ হাতে নিয়ে এই চক্রটিকে আইনের আওতায় নেওয়া হবে।

ওই কর্মকর্তা বলেন, পলাতক চক্রটিকে গ্রেপ্তার করার পর বোঝা যাবে, এরা শুধু কামরুলের কাছ থেকেই ফাঁকা সনদ ও নম্বরপত্র তৈরি করত, নাকি আরও অন্য কোথাও থেকে তা পেত। পুরো বিষয়টিই তদন্তের আওতায় নেওয়া হয়েছে।

- Advertisement -spot_img

রাজনীতি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

আবেদন করতে ব্যানারে ক্লিক করুন...spot_img

সর্বশেষ সব খবর