বুধবার, সেপ্টেম্বর ১৮, ২০২৪
spot_img

মিয়ানমার সীমান্ত অস্থির, সব জেনেও হাত গুটিয়ে আছে বাংলাদেশ

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্ত অঞ্চলে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর ছোড়া গুলিতে বাংলাদেশি নাগরিকের প্রাণহানি; বিদ্রোহী গোষ্ঠীর দ্বারা বাংলাদেশি নাগরিক অপহরণ ও পরবর্তীতে হত্যা; মর্টার শেল বিস্ফোরণ এবং যুদ্ধক্ষেত্র থেকে  মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষীদের বাংলাদেশে পালিয়ে আসা -এসব ইদানিং বেশ স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে । প্রতিটি ঘটনার পর মূলধারার গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশ আলোচনা-সমালোচনা হয়; সরকারের পক্ষ থেকে ‘ধৈর্য ধারণ’ ও ‘আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের’ কথা বলা হয়; কিছুদিন পর আবারও একই ধরনের ঘটনা ঘটে। 

সম্প্রতি সেন্টমার্টিনগামী ট্রলার ও স্পিডবোটে উপর্যুপরি গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটে। প্রশাসন অনেকটা বাধ্য হয়ে দ্বীপটিতে নৌপরিবহন বন্ধ রাখে। আবারও গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশ শোরগোল শুরু হয়। মন্ত্রীরা আগের মতো ‘আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের’ কথা বলতে থাকেন। প্রশ্ন হচ্ছে,  প্রথাগত কূটনীতির মাধ্যমে বাংলাদেশের দক্ষিণপূর্ব সীমান্তের সমস্যাগুলো সমাধান সম্ভব হচ্ছে কি বা হবে কি?  

স্বাধীন হওয়ার পর থেকে বাংলাদেশ রোহিঙ্গা শরণার্থীর ভার বহন করে আসছে। ঢাকার কাছে মিয়ানমারের আচরণ অপরিচিত নয়। ২০১৭ সালে যখন আবার রোহিঙ্গা সংকট তৈরি হয়, ঢাকা জেনেবুঝে, কোনো গ্যারান্টর ছাড়া নেপিডোর সাথে দুর্বল দ্বিপাক্ষিক প্রত্যবাসন চুক্তি করে বসে। চুক্তি সম্পর্কে তখনকার পররাষ্ট্র সচিব শহিদুল হক জানিয়েছিলেন, মিয়ানমার প্রতিদিন ৩০০ করে প্রতি সপ্তাহে ১৫০০ রোহিঙ্গাকে ফেরত নেবে এবং দুই বছরের মধ্যে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন শেষ করা হবে। তখন প্রশ্ন উঠেছিল, সপ্তাহে ১৫০০ জন করে ফেরত নিলে শিবিরের সব রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে প্রায় ১৫ বছরের বেশি সময় লাগবে! মিয়ানমারের মতো অনির্ভরযোগ্য পক্ষের সাথে দ্বিপাক্ষিক প্রত্যাবাসন চুক্তি বাস্তবায়ন সম্ভব হবে কিনা? সরকারের পক্ষ থেকে তখন জানানো হয়েছিলো, ‘মিয়ানমার তিন মাস পর পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে প্রত্যাবাসনের সংখ্যা বাড়াবে।’ বাস্তবতা হচ্ছে, ৭ বছর হতে চললো, বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত ১ জন রোহিঙ্গাকেও মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতে পারেনি। অর্থাৎ, মিয়ানমারের সাথে সরকারের ‘আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের’ কৌশল কাজ করেনি। 

এরপর মিয়ানমারের অভ্যন্তরে সৃষ্টি হলো নতুন সংকট। ২০২১ সালে সামরিক বাহিনী অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করলে দেশজুড়ে শুরু হয় ভয়াবহ গৃহযুদ্ধ। এই গৃহযুদ্ধে একদিকে রয়েছে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী, অন্যদিকে নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকার ও বেশ কয়েকটি জাতিগত সশস্ত্র সংগঠন। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে ঢাকা এতোদিন যে কোয়াসি-মিলিটারি সরকারের সাথে আলোচনা চালিয়ে আসছিলো, সে সরকারের নেতারা হয় অন্তরীণ না হয় নির্বাসিত। নেপিডোতে মিন অং হ্লাইংয়ের যে সামরিক সরকার রয়েছে  তারাও এখন কোণঠাসা। দেশটির সীমান্তবর্তী কোনো অঞ্চলেই তাদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেই।  রোহিঙ্গাদের আবাসভূমি আরাকানেও তাদের পূর্ণ  নিয়ন্ত্রণ নেই। জাতিগত সশস্ত্র সংগঠন আরাকান আর্মি উত্তর আরাকানের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দক্ষিণে অগ্রসর হচ্ছে। অর্থাৎ, রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে হলে ঢাকাকে  আরাকান আর্মির সাথে আলোচনা করতে হবে।

প্রশ্ন হচ্ছে, ঢাকা আরাকান আর্মির মতো নন স্টেইট অ্যাক্টরের সাথে সরাসরি আলাপে যেতে পারে কি? উত্তর হচ্ছে- পারে না। ঢাকাকে আরাকান আর্মির মতো নন স্টেইট অ্যাক্টরের সাথে আলাপের জন্য সাব-স্টেইট ডিপ্লোম্যাসিতে যেতে হবে। দ্বিতীয় প্রশ্ন হচ্ছে, রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে আরাকান আর্মির দৃষ্টিভঙ্গি কী? আরাকান আর্মির বিশাল সংখ্যক রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের সক্ষমতা বা ইচ্ছা আছে কি? উত্তর হচ্ছে – আরাকান আর্মির কাছে রোহিঙ্গা পরিচয় গ্রহণযোগ্য নয়। তাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া ফ্যাসিলিটেইট করার সক্ষমতা নেই। আরাকান আর্মির আচরণ পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, রোহিঙ্গা প্রশ্নে তাদের অবস্থান বেশ অসামঞ্জস্যপূর্ণ। গত কয়েকমাসে তারা বেশ কয়েকজন বাংলাদেশি নাগরিককে অপহরণ ও হত্যা করেছে। তাদের মধ্যে বাঙালি বিদ্বেষের বিভিন্ন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে । অর্থাৎ, আরাকান আর্মির সাথে ঢাকার ‘আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের’ কৌশল কার্যকর নাও হতে পারে।

ইউএনএইচসিআরের তথ্য অনুযায়ী,  উখিয়ায় ও টেকনাফ ক্যাম্পে রেজিস্টার্ড রোহিঙ্গার সংখ্যা ৯ লাখ ৭১ হাজার ৯০৪। ক্যাম্পে তাদের আনুষ্ঠানিক শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা নেই। প্রতি বছর  যুক্ত হচ্ছে ৩৫ হাজার নতুন শিশু। ৩% হারে যদি নতুন জনসংখ্যা যুক্ত হতে থাকে, তাহলে আগামী ৫ বছরে সৃষ্টি হবে এক হারানো প্রজন্ম, যারা থাকবে না কোনো শিক্ষা, থাকবে না কোনো কাজের দক্ষতা, থাকবে না রাজনৈতিক সচেতনতা। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে ক্যাম্পের এই বিশাল জনগোষ্ঠীর কোনো শক্তিশালী সংগঠন নেই। নেই গ্রহণযোগ্য কোনো রাজনৈতিক প্রতিনিধি। ঢাকাকে কি একবারও ভাবছে, ক্যাম্পের ‘টিকিং টাইম বোম্ব’ বিস্ফোরণ হলে তা কীভাবে মোকাবিলা করবে? 

অন্যদিকে, শরণার্থী ক্যাম্পগুলোতে অপরাধী চক্র ও  সশস্ত্র সংগঠন গড়ে ওঠা খুব স্বাভাবিক ঘটনা।   সাধারণত শরণার্থী আগমনের বছর দুয়েক পর থেকে কিশোর ও যুবকরা সশস্ত্র সংগঠন বা অপরাধী চক্রের দিকে ঝুঁকতে থাকে। উখিয়ার ক্যাম্পগুলোতে ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি অপরাধী চক্র ও সশস্ত্র সংগঠনের সৃষ্টি হয়েছে। তারা মাদক চোরাচালান, মানব পাচার, হত্যাসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধ করছে। ফলে স্থানীয় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, প্রশাসন, বিচার ব্যবস্থা প্রচন্ড চাপের মধ্যে পড়ছে।  

 শরণার্থী ক্যাম্প থেকে গড়ে ওঠা সশস্ত্র সংগঠনগুলো যে শুধু ক্যাম্প অস্থিতিশীল করে তা নয়। ফিলিস্থিন, কঙ্গো, রুয়ান্ডা, থাইল্যান্ড ও ক্যাম্বোডিয়া বর্ডারে সশস্ত্র সংগঠনগুলোকে ভয়াবহ আঞ্চলিক অস্থিরতা সৃষ্টি করতে দেখা গেছে।  মিয়ানমার সীমান্তের নো ম্যান্স ল্যান্ড, তোতার দ্বীপসহ বেশ কয়েকটি জায়গায় ইতোমধ্যে কিছু ঘটনা ঘটেছে। ভবিষ্যতে এসব ঘটনা কোন দিকে মোড় নেয় তা বলা মুশকিল। প্রশ্ন হচ্ছে, ঢাকা কি আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতা মোকাবিলায় প্রস্তুত?

অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে, দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় বছরে আনুমানিক ৬০-৭০ বিলিয়ন ডলারের অবৈধ মাদক বাণিজ্য হয়। বিশাল এই মাদক বাণিজ্যের সবচেয়ে বড় যোগানদাতা হচ্ছে মিয়ানমার। মিয়ানমারে যতদিন সংঘাত থাকবে, দক্ষিণ-দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে ততদিন মাদক সুনামি অব্যাহত থাকবে। কারণ, মিয়ানমারের এথনিক আর্মড অর্গানাইজেশন ও মিলিশিয়াদের অর্থের বড় একটি অংশের জোগান আসে এই মাদক উৎপাদন ও বিপণন থেকে। মিয়ানমারের মাদক সুনামির অন্যতম ভিকটিম হচ্ছে বাংলাদেশের। দক্ষিণপূর্ব সীমান্ত ও বন্দরগুলোর দুর্বল নিরাপত্তা ব্যবস্থার কারণে বান্দারবান ও কক্সবাজার জেলা এখন মাদক পাচারের নিরাপদ রুট। সাথে যুক্ত হয়েছে বঙ্গোপসাগরের বিশাল সমুদ্র পথ। শান-মান্দালায়-ইয়াঙ্গুন-রাখাইন-কক্সবাজারকে এখন দক্ষিণ- দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার অন্যতম নিরাপদ মাদক কোরিডোর বলা হয়। ইউনাইটেড নেশনস কনফারেন্স অন ট্রেড অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে মাদকের কারণে প্রতি বছর পাচার হয়ে যায় আনুমানিক ৫ হাজার ১৪৭ কোটি টাকা। এই টাকার বড় একটি অংশ যায় মিয়ানমারের বিভিন্ন সশস্ত্র সংগঠনের হাতে। 

অন্যদিকে, মাদক চোরাচালান বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্তের পুরো অর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা বদলে দিয়েছে। মাদকের অর্থের কাছে রাজনীতি, প্রশাসন, আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা, বিচার ব্যবস্থা ভয়াবহভাবে পরাভুত। বছর কয়েক আগে সরকারের কথিত মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ আশানুরূপ ফল দিয়েছে বলে মনে হয়নি। মাদক চোরাচালান কমা তো দূরের কথা, উল্টো বেড়েছে। অর্থাৎ, এই ফ্রন্টেও ঢাকা কার্যত ব্যর্থ। 

সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে মিয়ানমার সীমান্তে এই সমস্যাগুলো নতুন নয়। স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশ এই সমস্যাগুলো মোকাবিলা করে আসছে। ঢাকার নীতি নির্ধারকরা খুব ভালোভাবে জানেন, মিয়ানমার আন্তর্জাতিক নিয়মনীতি তোয়াক্কা করে না। তাদের কাছে প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্ক ভালো রাখা ‘প্রায়োরিটি’ নয়। মিয়ানমারের মতো জটিল প্রতিবেশীর সঙ্গে ঢাকা গত ৫০ বছর ধরে ‘আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের’ যে কৌশল অবলম্বন করেছে তা আশানুরূপ ফল দেয়নি। মিয়ানমার প্রশ্নে ঢাকার নীতি ও কৌশলকে অবজেকটিভলি বিশ্লেষণ করার সময় এসেছে। মিয়ানমার বাংলাদেশের নিরাপত্তাকে ঝুঁকিতে ফেলেছে। প্রতিনিয়ত সার্বোভৌমত্বকে চ্যালেঞ্জ করছে। দক্ষিণপূর্ব সীমান্তের পরিস্থিতি যেভাবে পরিবর্তন হচ্ছে তাতে ঢাকার হাত গুটিয়ে বসে থাকা বা সুবোধ পর্যবেক্ষক হওয়ার সুযোগ নেই। 

মিয়ানমারের মতো জটিল প্রতিবেশীকে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, চীন ও থাইল্যান্ড বেশ স্মার্টলি ডিল করছে। প্রথাগত কূটনীতির পাশাপাশি তারা সাব-স্টেইট ডিপ্লোম্যাসিকে গুরুত্ব দিচ্ছে। মাল্টি লেভেলের এনগেইজমেন্টে যাচ্ছে। যেখানে ডিপ্লোম্যাসি ফেইল করছে সেখানে  প্রয়োজন অনুযায়ী সামরিক বাহিনীকে ডেটারেন্স হিসেবে ব্যবহার করছে। ঝুঁকি কমাতে ‘আনকনভেনশনাল ডেটারেন্স’ প্রয়োগ ও ‘বাফার’ তৈরি করছে। দিল্লী, বেইজিং, ব্যাংকক পারলে ঢাকা পারছে না কেন? মিয়ানমার প্রতিনিয়ত বাংলাদেশের আকাশসীমা লঙ্ঘন করছে, ভূমিতে মর্টার শেল ফেলছে, গুলি করে নাগরিক হত্যা করছে, বেসামরিক নৌপরিবহনে গুলিবর্ষণ করে সেন্টমার্টিন দ্বীপের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে। বাংলাদেশের  সামরিক বাহিনী কোথায়? তাদের কাজ কী? বাংলাদেশ যুদ্ধ চায় না। তার মানে এই নয় আক্রমণ হলে প্রতিরোধ করবে না। নিজের নাগরিকের নিরাপত্তা দেবে না। 

দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্তে সমস্যার শেষ নেই। এ নিয়ে এখন পর্যন্ত জাতীয় সংলাপ বা পরামর্শ কোনোটাই হয়নি। জটিল সীমান্ত সমস্যা বা রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে কোনো কমিশনও গঠন হয়নি। কেন? বাংলাদেশ কার আশায় প্রহর গুনছে? পৃথিবীর কোথাও ডেটারেন্স বিহীন ডিপ্লোম্যাসি দিয়ে জটিল সীমান্ত সমস্যা বা শরণার্থী সমস্যা সমাধান হয়নি। ঢাকার নীতি-নির্ধারকরা এসব খুব ভালো করেই জানেন। সব কিছু জেনেও দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্তের সমস্যাকে আরও জটিল হতে দেওয়া হচ্ছে কেন?

- Advertisement -spot_img

রাজনীতি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

আবেদন করতে ব্যানারে ক্লিক করুন...spot_img

সর্বশেষ সব খবর