আব্দুল্লাহ আল নাঈম: পিতা-মাতার পর ছাত্রছাত্রীদেরকে মানবীয় গুণাবলি দিয়ে গড়ে তোলার কারিগর বলা হয় শিক্ষককে। কিন্তু তারাই যদি নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়েন, তাহলে শিক্ষার্থীরা নীতি নৈতিকতা শিখবে কোথা থেকে। শিক্ষককে যখন আস্থার ভরসা হিসেবে না পেয়ে অনাস্থার ভরসায় পাই তখন আমরা বলতেই পারি রক্ষক যখন ভক্ষকের ভূমিকায় আবির্ভূত হয়েছে। নৈতিক ও চারিত্রিক নানা কুকর্মে লিপ্ত হয়ে দুর্নাম কুড়িয়ে চলেছেন একশ্রেণির শিক্ষক। এতে নষ্ট হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার পরিবেশ। বিশেষ করে ছাত্রীরা হয়ে পড়ছেন উদ্বেগ ও নিরাপত্তাহীন।
সম্প্রতি মূলধারার বিভিন্ন জার্নালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ঘটনা প্রকাশ পেয়েছে। প্রতিবেদনগুলোতে বলা হয়েছে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) চারুকলা অনুষদের গ্রাফিক ডিজাইন, কারুশিল্প ও শিল্পকলার ইতিহাস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মনির উদ্দিন আহমেদের বিরুদ্ধে ছাত্রীকে যৌন হয়রানি, শিক্ষার্থীদের ফেল করানোর ভয় দেখানোসহ শারীরিক ও মানসিক নানা নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে। এছাড়া গভীর রাতে নারী শিক্ষার্থীদের ভিডিও কল ও মেসেজ দিয়ে বিরক্ত করা এবং অশালীন ভিডিও পাঠান।
গণমাধ্যমকে ওই নারী শিক্ষার্থী জানিয়েছেন— ‘মনির স্যার প্রায়ই মেয়েদের জামার ভেতরের পোশাক নিয়ে আজেবাজে কথা বলতেন। তিনি একদিন আমাকে বলেন, ‘জামার ভিতরে কী পরেছো, সব তো দেখাই যাচ্ছে। কালার বলব, কালার?’ এই বলে উনি হাহা করে হাসতে থাকেন। উনি ক্লাসে প্রায়ই ডাবল মিনিং কথাবার্তা বলতেন। ক্লাসে এসে তিনি বলেন, ‘মেয়েরা কলা বেশি করে খাবে, ছেলেরা কলা খাবে না। মেয়েদের তরমুজ ভালো আর ছেলেদের সাগর কলা ভালো।’ আমার এক সহপাঠীকে বলেন, ‘তুমি বেগুন বেশি বেশি করে খাবা, বেগুন খেতে অনেক মজা। বেগুন খেয়েছো কখনো?’ এছাড়াও তিনি বলতেন, ‘আমার তিনটা পা আছে। আমার তিন নম্বর পা ধরে রিকোয়েস্ট করলে তোমার রিকুয়েস্ট শুনব।’
আমি বিস্ময়ের সাথে পুরো প্রতিবেদনটি পড়েছি এবং সেই শিক্ষকের জন্য ঘৃণা ছাড়া অন্যকিছুর উদ্রেক ঘটেনি। এখন প্রশ্ন জাগছে— বিশ্ববিদ্যালয় হলো নীতি নৈতিকতা শেখা ও শেখানোর জায়গা। কিন্তু সেই নৈতিকতা শেখানোর বদলে এমন অনৈতিক কার্যকলাপ এবং বর্বর শিক্ষক কিভাবে তার চাকুরীতে বহাল তবীয়তে থাকছেন, কেন তাকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করা হচ্ছে না, এই প্রশ্ন এখন জনে জনে।
একটি শিল্পকারখানার উত্থান-পতনের মূলক্ষেত্র হলো ফ্যাক্টরির কারিগর তথা ইঞ্জিনিয়ার। সেখানে ইঞ্জিনিয়ার যদি অসৎ এবং মূল্যবোধহীন হয় তাহলে ফ্যাক্টরিটি ধ্বংস হয়ে যায়। ঠিক তেমনি একটি বিশ্ববিদ্যালয় একটি জাতি তৈরির কারখানা। সেখানের কারিগররা যদি ভালো না হন তাহলে সেই কারখানা থেকে ভালোকিছু আশা করাটাই ভুল, সেটি একসময় ধ্বংস হয়ে যায়। নতুন করে দেশ সংস্কার ও পুনর্গঠনের কাজ শুরুর গতিতে জাতিগড়ার কারখানা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও পুনর্গঠন করা এখন সময়ের দাবী। আশাকরি ছাত্র-জনতার তীব্র গনঅভ্যুত্থানের পরবর্তী সময়ে নতুন জনআকাঙ্ক্ষার প্রতীক হিসেবে ক্ষমতার দায়িত্বগ্রহণ করা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি মহোদয় ও অধ্যাপক ড. ইউনুস সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের ব্যক্তিবর্গরা মাটির আওয়াজ বুঝবেন।
আমাদের দেশে কিছু সুশীল রয়েছেন যারা সবসময় নারী অধিকারের কথা বলে মিডিয়া বিভাগ গরমের সুযোগ নিলেও প্রকৃতপক্ষে নারী যখন নির্যাতিত হয় তখন তাদের বাইনোকুলার দিয়ে খুঁজে পাওয়াটা দুষ্কর হয়ে যায়। এরআগে আমরা দেখেছি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে নারী শিক্ষার্থীদের পোশাকের স্বাধীনতা ক্ষুণ্নের অভিযোগ উঠলেও প্রতিবাদে খুঁজে পাওয়া যায়নি সেই নারীসুশীলদের। এমন কি একটি বিবৃতিও প্রকাশ করার সৎসাহস দেখাতে পারেননি তারা।
এরআগে যৌন নিপীড়নের দায় ও তীব্র লাঞ্ছনা আর সমালোচনার মুখে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিক্স বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মাহমুদুর রহমান জনিকে বরখাস্ত করতে বাধ্য হয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। তার অপরাধ— ২০২২ সালের ২১ নভেম্বর নিজ বিভাগের শিক্ষার্থী ও সে সময় সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত প্রভাষক আনিকা বুশরা বৈচির একটি অন্তরঙ্গ ছবি (সেলফি) বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন স্থানে পোস্টারিং হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। এছাড়া একই বিভাগের ৪৩ ব্যাচের আরেক ছাত্রীর সঙ্গে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক ও ভুক্তভোগী ছাত্রীকে জোরপূর্বক গর্ভপাত করানোর অভিযোগ ওঠে জনির বিরুদ্ধে। এই জনিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক সবাই ‘ললিপপ জনি’ নামেই চেনে এবং সেসময় ললিপপ জনির কুকীর্তির নিয়ে পোস্টারে পোস্টারে ছেয়ে গিয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা। সে শিক্ষার্থী থাকাকালীন ছাত্রলীগ করার সুবাদে এই চাকুরীটা পেয়েছিলেন। এভাবে করে শিক্ষকের মূল্যবোধহীন অনৈতিক কার্যকলাপের ফিরিস্তি গুগলে সার্চ করলেই শতশত দেখতে পাই।
মূলকথায় আসি— বিশ্ববিদ্যালয় হবে জাতি গড়ার সূতিকাগার। শিক্ষা, গবেষণা, প্রযুক্তি, উদ্ভাবন নিয়েই চলবে বহির্বিশ্বের সঙ্গে টক্কর। কিন্তু কলুষিত শিক্ষক রাজনীতি, ক্যাম্পাসে লেজুড়বৃত্তিক সন্ত্রাসের রাজনীতিসহ যেকোনো অস্বাভাবিক কর্মকান্ডের আস্তানা হয়ে উঠেছে বিশ্ববিদ্যালয়। এ সবকিছুর ভেতর থেকে বেরিয়ে শিক্ষা, গবেষণা, প্রযুক্তি, উদ্ভাবনের সমন্বয়ে এক স্ট্যান্ডার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারা দেখতে চাই।
নৈতিকতা কোর্স চালু করতে হবেঃ
বিগত দেড়যুগের পুরো সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে কতটুকু নৈতিকতাপূর্ণ শিক্ষক গড়ে উঠেছে। সেই প্রশ্নটির উত্তরের সুফলের চেয়ে কুফলই বেশি দৃশ্যমান। এজন্য প্রয়োজন হয়ে উঠেছে শিক্ষাসংস্কার ও নৈতিকতা শেখানোর উদ্যোগ গ্রহণের। নৈতিকতা বিষয়ে আমরা যেগুলো উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারি—
১. এক বছর বা ছয় মাসের ‘মূল্যবোধ ও নৈতিকতা কোর্স’ চালু করা এখন সময়ের দাবী। যেখানে বিজ্ঞ স্কলারগণ বা প্রশিক্ষকগণ দায়িত্বটি পরিচালনা করবেন।
২. শিক্ষক ও ছাত্রীর মধ্যে কোনো বাবা-মেয়ের সম্পর্ক হতে পারে না। এমন অযৌক্তিক ও উদ্ভট চিন্তা থেকে বিশ্ববিদ্যালয় তথা পুরো সমাজকে বেরিয়ে আসতে হবে। যদি তাই হতো তাহলে শিক্ষক নামের আবরণে কথিত বাবারা কখনো তার ছাত্রীদেরকে কুকর্মের ইশারা ও যৌনালাপ জুড়ে দিতেন না। ছাত্রীদের কোমলতার সুযোগ নেয়া ব্যক্তিরা বাবা নয়, চরিত্রহীনই হয়।
৩. শিক্ষার্থীদের নিরাপদ শিক্ষাপরিবেশ নিশ্চিত করতে জাতীয়ভাবে এর সমাধান খুঁজতে হবে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীদের নিরাপত্তার বিষয়ে যৌক্তিক আইনপ্রণয়ন করতে হবে।
৪. ছাত্রীদের জন্য নিরাপদ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিশ্চিত করতে হলে শিক্ষকতা পেশায় নৈতিকতা সম্পন্ন উপযুক্ত ব্যক্তিদের আনতে হবে। যৌনালাপ ও কুকর্মের ইশারা প্রদানকারী শিক্ষকদের স্থায়ী বরখাস্ত করে আইনের আওতায় এনে বিচার করতে হবে। তাহলেই এই জাতি নৈতিকতাসম্পন্ন একটি সমাজ বিনির্মান করতে সম্ভব হবে।
লেখক: মু. আব্দুল্লাহ আল নাঈম/শিক্ষার্থী, তা’মীরুল মিল্লাত কামিল মাদরাসা, টঙ্গী।