মোঃ সোহাগ আরেফিন, গুরুদাসপুর (নাটোর): বর্ষায় অথৈই জলরাশি আর গ্রীষ্মে দিগন্তের পর দিগন্ত আবাদি জমি এ নিয়ে গঠিত বাংলাদেশের বৃহত্তম বিল চলনবিল। এই বিলকে কেন্দ্র করে চাষিরা যেমন স্বপ্ন লালন করে, তেমনি জেলেরা স্বপ্নের জাল বুনন করে। বিলকে কেন্দ্র করে শুধু চাষি ও জেলেরাই স্বপ্ন দেখে না, স্বপ্ন দেখে চলনবিল অঞ্চলের প্রতিটি মানুষ এবং দেশবাসী আশায় থাকে চলনবিলে উৎপাদিত ধান ও স্বাদুপানির নানা প্রজাতির মাছের জন্য। পর্যটন আকর্ষক হিসেবেও চলনবিলের নাম সুবিস্তৃত।
ভরা বর্ষায় চলনবিল হয়ে ওঠে অনন্তযৌবনা। অঢেল পানির মাঝে মাঝে দেখা মেলে কৃষকের বোনা আমন-আউশ ধান। আর অথৈ পানিতে নৌকা ভাসিয়ে জেলেরা মাছ ধরে। চলনবিলে প্রায় ৩৫ প্রজাতির মাছ পাওয়া যায়। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো বোয়াল, শোল, পুঁটি, পাবদা, খলসে, শিং, বেলে, চিংড়ি, আইড়, কই, বাইয়েমসহ বিভিন্ন সুস্বাদু মাছ। জেলেরা শেষরাতে জাল ও নৌকা নিয়ে মাছ ধরতে বিলে যায়। সকাল অবধি তারা মাছ ধরে স্থানীয় বাজারে বিক্রির জন্য নিয়ে আসে। আবার অনেকে বড়শি, খড়াজাল, ধর্মজাল, ঝাঁকিজাল ও সুঁতিজাল দিয়েও মাছ শিকার করে। এসব মাছ এলাকার স্থানীয়দের চাহিদা পূরণ করার পর তা দেশের বিভিন্ন জায়গার পৌঁছে দেওয়া হয়। সেইসঙ্গে সারা দেশে চলনবিলের সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। বর্তমানে চলনবিলের মাছ বিদেশেও রপ্তানি করা হচ্ছে।
বর্ষার পানি শেষ হতেই চলনবিলের কৃষকরা মাঠে নেমে পড়ে এবং পাকা আমন-আউশ ধান কাটা ও মারাই করার মহোৎসবের মেতে উঠে এবং মারাইকৃত ধান ঘরে তোলে। তারপর জমি থেকে ধানের আগাছা পরিষ্কার করে ইরি ধান চাষের জন্য জমি প্রস্তুত করে। সবাই ইরি ধানের বীজতলা তৈরির জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে। মাস দুয়েক পর চলে আসে ইরি মৌসুম। কৃষকরা চলনবিলের মাঠে ধান লাগাতে ভীষণ ব্যস্ত সময় পার করেন। কেউ কেউ জমির আইল বাঁধে, কেউ কেউ পাওয়ার টিলার দিয়ে জমি চাষ করে, আবার কেউ কেউ জমিতে পানি দেয়, মই দেয়। তখন শীতকাল চলে। কুয়াশা ভেদ করে দলবেঁধে কৃষকরা ধান রোপণ করতে হেঁটে হেঁটে জমিতে যায়। তাদের মাথায় ধানের বীজের বোঝা ও হাতে খাবারের পটলা। সূর্য ওঠার আগেই তারা যেন বিঘাকে বিঘা জমিতে ধান রোপণ করে ফেলে। তাদের সারিবেঁধে কাজ করার দৃশ্য যেন সত্যই অপূর্ব এক দৃশ্য ।কাজের ফাঁকে তাদের কণ্ঠে আঞ্চলিক গানের সুর এ যেন এক শিল্পের আকা অপূর্ব কাথামালা। কাজের আনন্দে গান গেয়ে তারা যেন শরীরকে চাঙা রাখে।
ইরি মৌসুমে চলনবিলের মানুষের অবসর যাপনের সুযোগ নেই। জমিতে ধানের চারা লাগানোর পর প্রতিনিয়ত জমিতে পানি সেচ দিতে হয়। শ্যালো-ইঞ্জিনের দ্বারা কৃষক তার ধানের জমিতে পানি দেয়। এখন অনেক স্থানে বৈদ্যুতিক মোটর ও বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন করপোরেশনের গভীর নলকূপ স্থাপনের কারণে কৃষকরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে। জমিতে আগাছা পরিষ্কার করা, সার দেওয়া ও পোকামাকড় প্রতিরোধ করে কৃষকরা তাদের ধানকে সতেজ করে রাখে। তখন চলনবিল যেন সবুজে ভরে ওঠে। ধানের জমি থেকে তুলনামূলক উঁচু জমিতে কৃষকরা বিভিন্ন ধরনের রবি শস্যের চাষাবাদ করে থাকে, যেমন গম, ডাল, সরিষা ও তিল। অনেকে শীতকালীন সবজি চাষ করে। শীতকালে কাঁচা সবজির ব্যাপক চাহিদা থাকায় গ্রাম পেরিয়ে সেসব শহরে চলে যায়।
চলনবিলের উর্বর মাটিতে ধানের ফলন যেমন ভালো হয়, তেমনি আলু, পটোল, পেঁয়াজ, রসুন ও ধনেপাতার ফলনও আশানুরূপ হয়। কৃষির বৈচিত্র্য থাকার কারণে চলনবিলের মানুষ কৃষিজ পণ্যের অভাবে ভোগে না।
যখন ইরি ধান ঘরে ওঠে, তখন চলনবিলের মানুষ সবচেয়ে বেশি ব্যস্ত সময় কাটায়। কৃষকেরা ধান কেটে মহিষের গাড়িতে করে ধান এনে উঠানে ফেলেন। তাই গৃহিণীরা সকালে ঘুম থেকে উঠে বাড়ির উঠান গোবর-জল দিয়ে লেপে রোদে শুকিয়ে ঝকঝকে করে তোলে। সোলানী ধানের আঁটিতে উঠান ভরে ওঠে, সেইসঙ্গে কৃষান-কৃষানির মনটাও সাফল্যে ভরে ওঠে। তারা স্বপ্ন দেখে ‘বছরটা এবার সুখেই যাবে।’ দিনের প্রথমভাগ জমিতে ধান কাটা হয় এবং বিকালে তা বিভিন্ন উপায়ে মাড়াই করা হয়। বর্তমানে আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করার কারণে কৃষকের শ্রম একটু লাঘবের পথে। শ্রমিকরা ধান মাড়াই করে আর গলা ছেড়ে গান ধরে। মাঝে মাঝে সৃষ্টিকর্তার নামে জয়োধ্বনি দিয়ে বিশ্বস্ততা প্রকাশ করে। ক্লান্ত শরীরে যখন দুর্দান্ত ঘাম ঝরে, তখন তারা গাছের ছায়ায় বিশ্রাম করে। শরীরের ক্লান্তি দূরীকরণে কাঁচা আম মাখানো খায়, বেলের শরবত খায়, অথবা টক আচার খায়। ধান মাড়ানোর পর ধান রোদে শুকানো হয়। সবাই মিলে ধান বাতাসে উড়িয়ে গুদামজাত ও বাজারজাত করে। সারা বছরের আহারের জন্য ধান সিদ্ধ করতে চাড়িতে ভিজিয়ে রাখে। শেষরাতে উঠে তা সিদ্ধ করে রোদে শুকানো হয়। তারপর চাল বানানোর মধ্য দিয়ে কৃষকদের ধানের আবাদ নেওয়া শেষের দিকে চলে আসে। তাও শেষ হয় না। পোয়াল পালা দেওয়ার দিন ভালো খাবারদাবারের আয়োজন করে তবেই না ধানের আবাদের দিনগুলো শেষ হয়। অপরদিকে অন্য জেলা থেকে আসা মহিষের গারোয়ানরা গাড়ি ভর্তি ধান নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা হয়। তাদের প্রত্যাশা, ‘আমরা আগামী বছর আবার আসব।’
চলনবিলের মানুষের জীবনজীবিকা ভারি বৈচিত্র্যময়। যাদের কৃষিজমি আছে, তারা কৃষিকাজ করে। কিন্তু যাদের বসতবাড়ি ছাড়া অন্য জমিজমা নেই তারা ভিন্ন ভিন্ন পেশায় নিয়োজিত। কেউ নদীতে নৌকা চালায়, কেউ বাজারে দোকানদারি করে, কেউ পরিবহন শ্রমিকসহ নানা ধরনের পেশায় নিয়োজিত। বিভিন্ন পেশার সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার মধ্য দিয়ে একে অপরের ওপর নির্ভরশীলতা বজায় রেখে চলেছে। সামাজিকতার স্পর্শে সবাই যেন আন্তরিক। এ অঞ্চলে বিয়ের অনুষ্ঠানসহ অন্যান্য অনুষ্ঠান উদ্যাপনে তার উৎকৃষ্ট নমুনা পাওয়া যায়। পরিবার সচ্ছল হলে প্রতিবেশী কেউই যেন দাওয়াত থেকে বাদ পড়ে না। ধুমধাম করে সব আয়োজন সম্পন্ন হয়। এলাকার মধ্যে বিয়ের আয়োজন হলে অনেকে গরুর গাড়ি, অনেকে শ্যালো নৌকা ব্যবহার করে থাকে। গানবাজনায় বিয়েবাড়ি মুখরিত হয়ে ওঠে। আনন্দ উদ্যাপনে চলনবিলবাসীর জুড়ি নেই। বিভিন্ন মেলা, নৌকাবাইচ, ঘৌড়দৌড়, পূজা-পার্বণ ও খেলাধুলার আয়োজন যেন সবার স্বচ্ছ বিনোদনের মাধ্যম। এসবের মধ্য দিয়ে চলনবিলের মানুষ তাদের অবসর যাপনকে প্রাণবন্ত করে রাখে।
চলনবিল অঞ্চলে প্রাচুর্য যেমন রয়েছে, তেমনি দারিদ্র্যও রয়েছে। ঘরবাড়ির দিকে নজর দিলে তার প্রমাণ মেলে। কেউ কেউ ইটের দালান তুলেছে, কেউ কেউ দামি টিনের ঘর তুলেছে। দরিদ্ররা ছনবনের ঘরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। অনেক সময় তারা জীবনজীবিকার তাগিদে শহরে পাড়ি জমায়। কিন্তু চলনবিলের মতো অনুকূল পরিবেশ না থাকায় তারা আবার নাড়ির টানে ফিরে যায়। তখন তাদের মনে বিশ্বাস জাগে ‘শরীর সুস্থ থাকলে এলাকাতেই ভাতের অভাব হবে না।’ যেহেতু চলনবিলে শ্রমের বৈচিত্র্য রয়েছে, তাই দারিদ্র্যের কশাঘাত থেকে পরিত্রাণ পাওয়া দুরূহ কিছু নয়। তবে সবাই ভাগ্যোন্নয়নের চেষ্টা চালায়। অনেক সময় পারিপার্শি^ক নানা কারণে জীবনযুদ্ধে হেরে যেতে হয়। এটাই বাস্তবতা। চলনবিলের মানুষ যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এখন শিক্ষিত হওয়ারও পথে। চলনবিলের অনেক গ্রাম আছে যেখানে শতভাগ লোক শিক্ষিত হয়েও কৃষিকাজ করে। চাকরির পেছনে না ছুটে পৈতৃক সম্পত্তিকে কাজে লাগিয়ে তারা এখন ভাগ্য গড়ার দিকে। এ অঞ্চলের অনেক কৃষকের সন্তানরা আজ দেশের বিভিন্ন স্থানে বড় বড় চাকরি করছেন। অনেক ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, আইনজীবী, এমপি-মন্ত্রী রয়েছেন। তারা সবাই গর্ব করে বলেন, ‘আমি চলনবিলের মানুষ, আমি একজন কৃষকের সন্তান।’
চলনবিল অঞ্চল যেমন কৃষি ও মাছের জন্য উপযোগী, তেমনি এলাকটি শিক্ষিত মানুষের আবাসস্থল। মানুষে মানুষে বন্ধন এ এলাকার একটি উল্লেখযোগ্য ভালো দিক। হানাহানি নয়, সম্প্রতির বন্ধনে সবাই যেন জীবনকে চলনবিলের স্রোতের মতো করে বাইয়ে চলেছে। নানা প্রতিকূলতাকে বিসর্জন দিয়ে সভ্য জাতি হিসেবে বছর বছর ধরে চলনবিলবাসী জীবনজীবিকা নির্বাহ করে।